Sovabazar Rajbari Durga Puja-Choto Torof-Boro Torof-Bonedi Durga Puja
Sovabazar Rajbari Durga Puja-Choto Torof-Boro Torof-Bonedi Barir Durga Puja
বনেদী পুজো ও সাবেকিআনার ওপর নাম শোভাবাজার রাজবাড়ির পূজো
কলকাতার বনেদী দুর্গাপুজো বলতে প্রথমেই যে পুজোর কথা মনে আসে তা হলো শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো।কলকাতার অন্যতম প্রাচীন পুজোও এটি,ভালোলাগার পুজো এটি।সাবেকি পুজোর ধারা বজায় রেখে আজও রাজবাড়ির বর্তমান প্রজন্ম নিষ্ঠা সহকারে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই পুজোর ধারা।
এই পুজোটি শুরু করেছিলেন যিনি এই রাজবাড়িরও প্রতিষ্ঠাতা, স্বয়ং রাজা নবকৃষ্ণ দেব বাহাদুর।
শৈশবে বাবাকে হারান নবকৃষ্ণ দেব। পিতা রামচরণ দেবের মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী তিন ছেলে ও পাঁচ মেয়েকে নিয়ে মেদিনীপুর থেকে গোবিন্দপুর চলে আসেন।পরে সেখান থেকে আসেন শোভাবাজার।এদের মধ্যে ছোটো ছেলে ছিলেন নবকৃষ্ণ দেব, যিনি নিজের ক্ষমতায় রচনা করেন ইতিহাস।মায়ের উদ্যোগে শিখেছিলেন আরবি,উর্দু ও ফারসি।পরে শিখেছিলেন ইংরেজিও।পরবর্তীকালে এই বহু ভাষায় পারদর্শিতা তার উন্নতির কারণ হয়ে উঠেছিল।যুবক নবকৃষ্ণ ব্রিটিশের কুঠিতে কাজ করতেন সাধারণ কর্মচারী হিসাবে।পরে তার নিজের উপস্থিতবুদ্ধি ও ফারসি ভাষা জানার সুবাদে হলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক।সুনজরে চলে এলেন সব উচ্চপদস্থ অফিসারদের।পলাশীর যুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ এর অন্যতম পরামর্শদাতা ছিলেন তিনি। সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে অকুণ্ঠ সাহায্য করেন তিনি ব্রিটিশদের।পলাশীর যুদ্ধে জয়ের পর সেই জয়কে উদযাপন করতে তিন মাসের মধ্যে তৈরি করা হলো ঠাকুরদালান,নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে বসলো দুর্গাপুজোর আসর।নবকৃষ্ণ মুন্সীর আনুগত্যে খুশি হয়ে তাকে দিলেন রাজা উপাধি।পরে নবাবের থেকে পেলেন বাহাদুর উপাধি। ঠাকুরদালানের ঠিক উল্টোদিকেই সোজাসুজি নাচঘর। তাই পুজোমণ্ডপে সরাসরি না এসেও সাহেবরা নাচঘর থেকেই অনায়াসে পুজো দেখলো।একদিকে পুজো ও খানাপিনা, আমদপ্রমোদ একসাথেই চলতে থাকলো বছরের পর বছর।লর্ড ক্লাইভকে খুশি করতে লক্ষ্ণৌ থেকে আনা হয়েছিল নামকরা বাইজীদের।ক্লাইভের পর বেন্টিংক,কর্নওয়ালিশ থেকে আরও কত কোম্পানির লোক।সাহেবদের মনোরঞ্জনের সব রকম ব্যবস্থা থাকত।থাকত বল ডান্সের ও ব্যবস্থা।
শোভারাম বসাকের থেকে আউট হাউস কিনে এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন।তিনি আসার পূর্বেই স্থানের নাম শোভাবাজার ছিল।শোভারাম বসাকের নামের বাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ি ' শোভাবাজার রাজবাড়ি ' নামে বিখ্যাত হল দিন দিন।
Related Posts : Chatu-Babu-Latu-Babu, Kolkata Heritage Buildings, Itachuna Rajbari,Top 50 Bonedi Barir Durga Pujo
অপুত্রক নবকৃষ্ণ দেব ভাইয়ের ছেলে গোপীমোহনকে দত্তক নেন।পরে যদিও চতুর্থ স্ত্রী জন্ম দেন এক পুত্রসন্তান,' রাজকৃষ্ণ '।আগের রাজবাড়ি তো ছিলই।এবার নতুন আর এক রাজবাড়ি তৈরি করলেন তিনি।দুই ছেলের নামে দুই বাড়ি। বড় তরফ ও ছোটো তরফ।
৩৫,রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট,এটাকেই মূলত শোভাবাজার রাজবাড়ি হিসাবে চেনেন সবাই।এটাই বড়ো তরফের পুজো।মূল ফটকের সামনে দুখানি সিংহ উপবিষ্ট থাকায় এটিকে বাঘওলা বাড়িও বলে কেউ কেউ। ৩৩,রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিট,যেটা ছোটো রাজবাড়ি বা ছোটো তরফের পুজো বলে খ্যাত।
উৎকল নিবাসী ব্রাহ্মনরাই পুজোর কাজ করছেন বংশানুক্রমিকভাবে।প্রথম যখন নবকৃষ্ণ দেব পুজো করবেন মনস্থ করেন তখন কৃষ্ণনগর থেকে দুই ঘর কুমোর এনে তাদের জায়গা দেন গঙ্গা সংলগ্ন অঞ্চলে,যেটাই আজকের কুমোরটুলি।তবে প্রথম বছর থেকেই যদিও প্রতিমা তৈরি হয় রাজবাড়ীতেই।আজও ঠাকুরদালানেই হয় প্রতিমা তৈরির কাজ। রথের দিন হয় কাঠামো পুজোর কাজ।
১৭৯০ সাল থেকে দুটি পুজো হয়ে যায়,বর্তমানে বড়ো তরফ ও ছোটো তরফ বলে পরিচিত।
পুজোর বিশেষত্ব : প্রতিটি বনেদী বাড়ির পুজোর ক্ষেত্রেই থাকে কিছু বিশেষ রীতিনীতি।এখানেও তেমন।মা এখানে বৈষ্ণবী মতে পূজিত হন।নবকৃষ্ণ দেবের পরিবার যেহেতু কায়স্থ তাই পুজোয় অন্নভোগ দেয়া হয় না।পরিবর্তে দুবেলা মিঠাই এবং নোনতা ভোগ ও কাঁচা অন্ন নিবেদন করা হয়। মেদিনীপুর নিবাসী হালুইকররা এসে সেই মিঠাই তৈরি করেন বংশপরম্পরায়।
১৭৫৭ সালে যখন পুজো শুরু হয় তখন আলুর প্রচলন ছিল না।তাই আজও পুজোয় আলু ব্যতীত রান্না হয়,ভোগেও তাই।এমনকি বাড়ির সদস্যদের রান্নাতেও পুজোর কদিন আলুর ব্যবহার করা হয় না।
মূর্তি ও ঠাকুরের বিশেষত্ব : মূর্তি সাবেকি ধারায় একচালা। চালচিত্র ও প্রতিটি মূর্তির আলাদা মাপ ও ছাঁচ আছে। সেই ১৭৫৭ সালের ছাঁচের আদলেই আজও মূর্তি তৈরি হয়।
শোভাবাজার রাজবাড়ির উত্তরসূরীদের বক্তব্য রুপোলি সাজ কলকাতায় তারাই প্রথম আনেন।আগে জার্মানি থেকে আনা হতো।যেটা বর্তমানে ' ডাকের সাজ ' হিসাবে খ্যাত।বড়ো তরফের ডাকের সাজ রুপোলি সাজের তবে সোনালীও হতে পারে। সিংহ আইভরি রঙের ও দেখতে ঘোড়ার মত।
অন্যান্য সাবেকি বাড়ির সাথে প্রতিমার সাজেও পার্থক্য অনেক। বাঙালি ঘরানার নয়,বরং মা দুর্গা ও তার সন্তান সন্ততি সেজে ওঠেন ডাকের সাজের পশ্চিমীশৈলীর ঘরানায়।তবে পার্থক্য এতটাই সূক্ষ্ম যে চট করে চোখে পড়ে না।মা ও তার দুই মেয়ের পরনে থাকে রাংতার পোশাক,যদিও দূর থেকে দেখলে অনায়াসে মনে হবে বেনারসী পরিহিত।মায়ের গয়নার ক্ষেত্রেও মুঘল ঘরানার বা আওয়াধ এর নবাব ঘরানার মিল পাওয়া যায়। অভিনবত্ব গণেশের পোশাকেও।ধুতি চাদরের পরিবর্তে এবাড়িতে তাঁকে মারওয়ারি সাজে দেখা যায়।
মা থাকেন চিকের আড়ালে।প্রতিমার সামনে ঝোলে ছোটো ছোটো অভ্র টুকরোর আবরণ।ফলে মুখ পুরোপুরি ঢাকাও পড়ে না,আবার আড়ালও থাকে। অতীতে বাড়ির বৌমেয়েরাও থাকত চিকের আড়ালে।আড়াল থেকেই তারা দেখতো বিনোদনের চাকচিক্য।
বছরে একবারই মে আসেন বাপের বাড়িতে।তাই তার মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা তো করতেই হয়।ঘরের মেয়েদের বিনোদনে কবি লড়াই,খেমটা,তরজা,টপ্পা,বাইনাচের থাকত এলাহি আয়োজন।সাবেক কলকাতায় বলত, মা দুর্গা এবাড়িতে আমোদে ডুবে থাকেন।তাই মা এখানে আমোদিনী।
পুজোর রীতিনীতি ও আচার অনুষ্ঠান : রথের দিন বড়ো তরফের কাঠামো পুজো হয়।পরের দিন থেকে ঠাকুর গড়ার কাজ শুরু হয়। ছোটো তরফের কাঠামো পুজো হয় উল্টো রথের দিন।
পঞ্চমীর দিন থেকে পুজো শুরু হয়ে যায় নিষ্ঠার সাথে।
ষষ্ঠীর দিন বাড়ির সদস্যদের উপস্থিতিতে গয়না পড়ানো হয়,অসুরও তাতে বাদ পড়েন না।আপনারাও এই অনুষ্ঠানের সাক্ষী হতে পারেন দালানের গেটের বাইরে থেকে।শুরু হয়ে যায় পুজোর তোড়জোড়। নিয়মিত দুবেলা পুজো ও আরতি চলতে থাকে। রাজবাড়ির নিজস্ব প্রাচীন বাল্মীকি রামায়ণ আছে,যা পাঠ করা হয়।চণ্ডীপাঠ করা হয়। বিশেষত্ব সপ্তমীর দিন সকালে 'কলা বউ স্নানে 'ও।আগে নবপত্রিকা স্নানে যাবার শোভাযাত্রা তাক লাগিয়ে দিত সবাইকে।মাথায় ধরা হতো ভেলভেটের ছাতা,যদিও আজ তা জীর্ণ ও দীর্ণ,তবুও সাবেকি আনার প্রতীকতো বটেই। অতীতে ঠাকুর দালানে সাজিয়ে দেওয়া হতো ৫২ রকমের ভোগ ও নৈবিদ্য।
বড়ো তরফে সপ্তমীর দিন চালকুমড়ো বলি হয় এবং ছোটো তরফে ছাগ বলি হয়।নবমীতে চালকুমড়ো, গোড়া সমেত আখ গাছ,দুটি জ্যান্ত মাগুর মাছ বলি দেওয়া হয়।দুতরফেই বলির পর প্রতিমার উদ্দেশ্যে অঞ্জলী প্রদান করা হয়।
সন্ধিপুজোয় ১০৮ প্রদীপ ও পদ্ম ফুল ফোটানোর রীতি আজও বহাল।বাড়ির ছেলে বউরাই তা সম্পন্ন করেন।সন্ধি পুজো শুরু হতো আগে কামানের গোলার আওয়াজে, কামান যদিও আজও বহাল।কিন্তু আজ পুজো শুরু হয় ফাঁকা বন্দুকের আওয়াজ দিয়ে।
আগে দশমীতে ঘোড়া পুজো করা হতো।এখন হয় না।তবে ঘোড়ার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয় ছোলা। ঐতিহ্য মেনে হয় কনকাঞ্জলি।আগে প্রতিমার সামনের সিঁড়ি দিয়ে উঠে পুরোহিতমশাই সোনা,মোহর ভরা চাল ছুড়ে ফেলতেন ও বাড়ির মেয়ে বউরা তা আঁচলবন্দী করতেন।এখন সিঁড়ি নয়,নিচে দাঁড়িয়েই ছুড়ে দেন। কাপড় বন্দী হয় সে কনকাঞ্জলি।সিন্দুকে তুলে রাখা হয়,পরের বছরের অপেক্ষায়।
নীলকন্ঠ পাখির ঐতিহ্য : দুটো নীলকন্ঠ পাখি ওড়ানোর ঐতিহ্য এবাড়ির।প্রথমটি ওড়ানো হতো যখন প্রতিমা নিয়ে গঙ্গা উদ্দেশ্যে রওনা হতো এবং দ্বিতীয়টি নৌকার মাঝখানে মাকে যখন বিসর্জন দেয়া হতো। অতীত বিশ্বাসে এই নীলকন্ঠ পাখিটি শিব ঠাকুরের কাছে কৈলাসে পৌঁছে দেন মায়ের রওনা হবার খবর।বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইন লাগু হাওয়ার পর থেকে পাখি ওড়ানো হয় না।মাটির পাখি গড়ে বিসর্জন দেয়া হয় জলে।সম্প্রতি বাড়ির সদস্যদের উদ্যোগে নীলকন্ঠ পাখির ছবি আঁকা ফানুস ওড়ানো হয়।
মাকে বিদায় জানানোতেও অভিনবত্ব।গঙ্গা ঘাটে দুটি নৌকাকে ভালো করে বেঁধে দেবী মাকে দুটি নৌকার মাঝের ফাঁকা অংশে রাখা হয়।নৌকা মাঝ গঙ্গায় গেলে কাঠামোর তলার বাঁশ সরানো হয় এবং দুটি নৌকার মাঝ দিয়ে প্রতিমা গঙ্গায় নিমজ্জিত হন।
পুজোর আড়ম্বর : পুজো আরম্ভের দিকে পুজোকে উদ্দেশ্য করে মেলা বসত। সানাই বাদকদের আনা হত বেনারস থেকে,বসত নহবত।এখন বাইরে মূল গেটে থাকে আতরওয়ালা।আলোর রোশনাই। ঠাকুর দালানের সামনের উন্মুক্ত খোলা প্রাঙ্গণে লোকের সমারহ।
ভোগ: দোকানের কেনা সন্দেশ আজ অবধি ঢোকেনি ভোগ হিসাবে এই বাড়িতে। চাল,নানা ফলাদি,খাজা, মিঠে গজা,দরবেশ, পান্তুয়া,জিলিপি, সিঙ্গারা, খাস্তাকচুরী,মতিচুর,নিমকি,নারকেল ছাপা।এই বাড়িতে পুজোয় নিবেদিত ভোগ এগুলোই।রাত্রে মাখন ও মিছরির সরবত। এ বাড়ির কুলোদেবতা গোবিন্দজী।পুজোর কদিন তার ঘরেও পাঠানো হয় খাজা মিষ্টান্ন ও নোনতা ভোগ।
এবার তবে বিদায় মাগো : দশমীর দিন সব গয়না খুলে নেয়া হয়।হয় দর্পন বিসর্জন।প্রতিমার সামনে বড় হাঁড়িতে জলে দেবীর পায়ের প্রতিবিম্ব দেখে প্রনাম করাই হলো এর রীতি।
মাকে এখনও কাঁধে করেই বাড়ি থেকে ঘাট অবধি নিয়ে যাওয়া হয়।
যখন পুজো শুরু হয়,নারীরা ছিল পর্দানশীন।তাই সিঁদুর খেলার চল ছিল না।কিন্তু এখন নতুনের ছোঁয়ায় মায়ের পায়ে লাগিয়ে সিঁদুর খেলা হয়। ঠাকুরদালানে জমে থাকা বেলপাতায় আলতা দিয়ে দূর্গানাম লিখে নিজেদের কাছে রাখতেন সবাই। সিঁদুর খেলার পরিবর্তে এটাই ছিল তখন রেওয়াজ।
সন্ধ্যায় বাড়ির সব সদস্যের উপস্থিতিতে শান্তি জলের পালা।তারপর কুলদেবতাকে প্রনাম সেরে শুরু হয় বাড়ির বড়োদের প্রনাম ও কোলাকুলি পর্ব।বিজয়া ও মিষ্টিমুখ।আবার একবছরের অপেক্ষা।।
লেখিকার মতে : একটা বিশেষ খবর আপনাদের দিয়ে রাখি।এই লোভনীয় মিষ্টি,নিমকি,গজার স্বাদ আপনারাও কিন্তু পেতে পারেন।খোলা মাঠের পাশের দালানেই বানানো হয় সে মিষ্টি।পরিবার, অতিথিবৃন্দকে দিয়ে যদি বেশি থাকে হালুইকররা তার বিক্রি করেন জনসাধারণের জন্য।লম্বা লাইন ও ধৈর্য্যর পরীক্ষা দিয়ে পেতে পারেন সেই লোভনীয় রাজবাড়ির মিষ্টান্নের স্বাদ।
তথ্যসূত্র : শ্রী রাজা দেব এবং আনন্দবাজার পত্রিকা
Extraordinary explanation
উত্তরমুছুন