খেলাত ভবন-পাথুরীঘাটা রাজবাড়ি-Khelat Ghose Bhavan-Pathuriaghata Rajbari-Bonedi Barir Durga Pujo-Pathuriaghata Jamidar Barir Durga Pujo
খেলাত ভবন-পাথুরীঘাটা রাজবাড়ি-Khelat Ghose Residence-Pathuriaghata Rajbari-Bonedi Barir Durga Pujo-Pathuriaghata Puja-Jamidar Barir Durga Pujo- Puja Parikrama
পাথুরীঘাটা,কলকাতার এক প্রাচীন,ইতিহাসের পাতায় স্মরণীয় হয়ে থাকা এক নাম। যে জায়গার সাথে জড়িয়ে আছে বহু পরিবারের উত্থান,পতন,বাবুগিরি,কত গুণী মহান মানুষের ঘটনা। আজও যে বাড়িগুলোর ইঁট কাঠ পাথর ফিসফিস করে বলে ঘোষ,মল্লিক, ঠাকুরদের বৈভবের কথা।সেই পাথুরীঘাটার ধনী সম্ভ্রান্ত এক পরিবার হল ঘোষ পরিবার।এই পরিবারের রামলোচন ঘোষ ছিলেন ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান।সেই সূত্রে প্রচুর অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়েছিলেন বলাই বাহুল্য।
৪৬এর পাথুরীঘাটা স্ট্রিটের বাড়ি থেকে ৪৭পাথুরীঘাটা স্ট্রীটে নতুন বাড়ি বানিয়ে উঠে গেলেন নাতি খেলাত চন্দ্র ঘোষ মহাশয়।এই বাড়িই খেলাত ভবন বলে পরিচিত।পাথুরীঘাটা রাজবাড়ি বা রাজবাটি বলতেও এটিই।ওয়ারেন হেস্টিংস ও তার পত্নী বহুবার এসেছেন এই বাড়িতে পুজো দেখতে।পুজোর প্রতিষ্ঠাতা হেস্টিংস স্ত্রীকে বাংলা শেখাতেন।শুধু ওয়ারেন হেস্টিংস কেনো রামকৃষ্ণ দেব থেকে মহাত্মা গান্ধী এককালে সকলের পায়ের ধুলোই পড়েছে এই বাড়িতে।কালী প্রসন্ন সিংহ মানে হুতোম পেঁচার লেখায় প্রায়ই উঠে আসত বাবু খেলাত চন্দ্র ঘোষের বৈভবের কথা।এই বাড়ি,এই পরিবারের সাথে শিল্প,সাহিত্য,সঙ্গীতের নিবিড় যোগসূত্র সেই প্রাচীন থেকেই।All Bengal Music Conference এখনও এই বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়।৮৬ টা ঘর, তার ও বেশি থাকলে অবিশ্বাস্য কিছু না।সিংহদুয়ারই বটে,মূল প্রবেশদ্বারের পাশে দুই সিংহ যেন অতন্দ্র প্রহরীর মত পাহাড়ায়।দুর্গা পুজো,জগদ্ধাত্রী পুজো হয় ঠাকুর দালানে নিষ্ঠা সহকারে।পুজোর কদিন সাধারণ মানুষের জন্য খুলে দেওয়া হয় এই বাড়ি।পাথুরীঘাটার অন্যান্য বাড়িগুলোর যেখানে জৌলুস হারাচ্ছে দিনদিন সেখানে এই বাড়ির রূপ জৌলুস আজও যেন তাক লাগায়।অবাক হয়ে শুধু দুচোখ ভরে দেখেছি।ঠাকুরদালান ঘিরে চারপাশে বাড়ি।প্রতি থাম লাগোয়া শ্বেত পাথরের মূর্তি বলে দেয় এই বাড়ির সোনালী অধ্যায়ের কথা।
হেস্টিংসের প্রিয় পাত্র রামলোচন ঘোষের তিন পুত্র -শিবনারায়ণ,দেবনারায়ণ ও আনন্দনারায়ণ। খেলাত চন্দ্র ছিলেন দেব নারায়নের পুত্র।তিনি ছিলেন অনারারি মেজিস্ট্রেট ও জাস্টিস অব দি পিস্।সাহেবদের সঙ্গে ব্যবসাপত্রের সুবাদেই তার সৌভাগ্যের সূচনা।তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।তাঁর দত্তকপুত্র রমানাথ ছিলেন বঙ্গদেশীয় কায়স্থ সভার প্রতিষ্ঠাতা।রমানাথের ছিল সাহেব ভক্তি।১৯০২ সালে মহারানী ভিক্টোরিয়া মারা গেলে কলকাতায় হাজার হাজার মানুষের শোক মিছিল হয়েছিল।মিছিলে যারা যোগ দিয়েছিলেন তাদের পেট ভরে খাওয়ানো হয়েছিল।পুরো ব্যাপারটাই তদারকি করেছিলেন বাবু রমানাথ ঘোষ ও তার বন্ধুবান্ধবরা।ঠিক কতটা অর্থ ও সাহেব ভক্তি থাকলে এটা সম্ভব সেটাই ভাবার বিষয়!লর্ড কার্জনের পরিকল্পনা অনুযায়ী যে ভিক্টোরিয়া স্মৃতি তহবিল গঠন করা হয় তাতে তিনি ২৭ হাজার টাকা দান করেছিলেন।১৮৯৮ এর মনন্তরে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষের সাহায্যের জন্য যে তহবিল গঠন করা হয় তাতে তিনি পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।অভাবী মানুষদেরও মুক্ত হস্তে দান করতেন।সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তিনি কয়েকটি অবৈতনিক টোল চালাতেন। রমানাথের তিন ছেলে - গণেশ, সিদ্ধেশ্বর ও অক্ষয়।সিদ্ধেশ্বরের আমলে গান্ধিজি এই বাড়ির নাচ ঘরে সভা করে গেছেন।কলকাতায় এদের শ খানেক বাড়ি আছে। খেলাত ঘোষের নামে পাথুরীঘাটায় রাস্তা আছে।রমানাথ ঘোষের নামে খড়দহে আছে রাস্তা।সাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খেলাত ঘোষ ইনস্টিটিউশনে শিক্ষকতা করতেন। পরে তিনি হন এ বাড়ির গৃহ শিক্ষক। সিদ্ধেশ্বর ঘোষের আমলে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে নায়েব করে ভাগলপুরের জমিদারির ভার দিয়ে পাঠানো হয়।সেখানে ইসমাইল কাছারিতে বসে তিনি তাঁর কয়েকটি বিখ্যাত গল্প ও উপন্যাস রচনা করেন।
সাবেক ভদ্রাসনের ঠিক পাশেই পাঁচ খিলান বিশিষ্ট দুর্গা দালান সহ্ প্রাসাদসম এই বাড়ি তৈরি করে সেখানেই খেলাত বাবু সাড়ম্বরে শুরু করেন দুর্গোৎসব।শহরের অভিজাত বনেদি বাড়ির পুজোগুলোর মধ্যে অন্যতম এই পুজো। রুপোলী রাংতা মোড়া সিংহাসনে দেবী বিরাজ করেন।প্রতিমার পিছনের চালি মঠচৌড়ি অর্থাৎ তিন চালি।এখানে দেবীর বাহন ঘোটকাকৃতি সিংহ।পুজোতে লুচি মিষ্টি মন্ডা ভোগের সাথে থাকে চিনির মঠ।পরিবারের লোক ছাড়াও বর্তমানে বাড়ির দেখাশোনার দ্বায়িত্বে রয়েছেন ৫ জন কর্মচারী যারা মূলত দেখেন অফিসের হিসাব,তাদের অধীনস্থ কর্মচারীর সংখ্যা অগুনতি।রাজা রাণীর গল্প ত আর নেই এখন তবুও তাঁদের মুখেই শুনলাম জীবিত রয়েছেন রাণীমা।কলকাতার বুকে এইসময় দাঁড়িয়ে রাণীমা কথাটা শুনে কিঞ্চিৎ অবাক লাগলেও বুঝতে অসুবিধা হলো না এই পরিবারের এটাই হয়তো সম্বোধনের রীতি।পুজো দেখার সাথে সাথে ঘুরে দেখলাম বাড়ির আনাচে কানাচে,খানিকটা ইতিহাসের পাতায় উঁকি ঝুঁকি মারার চেষ্টা আর কি!
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
If you have any query, please let me know.