Sarat Chandra Chattopadhyay's House-Sarat Kuthi-Deulti
Sarat Chandra Chattopadhyay's House-Sarat Kuthi-Deulti
শরৎকুঠি - ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিজড়িত শেষ জীবনের আশ্রয়স্থল,তার ব্যক্তিগত ও কর্মজীবনের দর্পণ।
কর্মসূত্রে হোক বা ব্যাক্তিগত কারণ, বাসা ছিল তাঁর অনেক ও নানান জায়গায় ছড়িয়ে।জন্মের পর দেবানন্দপুর,ভাগলপুর,রেঙ্গুন, বার্মা বা শিবপুরের ভাড়া বাড়ি।নিজের বাড়ি কিন্তু এটাই। যে কুটিরের প্রতিটি কোণায় লেগে রয়েছে তার স্পর্শ,আবেগ বিজড়িত মুহূর্ত,হৃদয়স্পর্শী সব লেখার সৃষ্টি।পাশেই বয়ে চলেছে রূপনারায়ণ আদি অনন্ত।মেজদিদি,ললিতা, চন্দ্রমুখী এই সব চরিত্রের রচয়িতার টানেই একদিন সকালে পৌঁছে গেছিলাম তাই সামতাগ্রামে।দেউলটির খুব কাছে।২০০৭ সাল থেকে এটি হেরিটেজ কমিশনের ঐতিহ্য ভবন হিসাবে স্থান পেয়েছে।
তাঁর স্মৃতি বিজড়িত ব্যাবহৃত জিনিস দিয়ে সাজিয়ে বাড়িটি বর্তমানে সংগ্রহশালা হিসাবে সংরক্ষিত।
You may also visit :
"আল্লা,আমাকে যত খুশি সাজা দিয়ো,কিন্তু মহেশ আমার তেষ্টা নিয়ে মরেছে,তার চরে খাবার এতটুকু জমি কেউ রাখেনি।যে তোমার দেওয়া মাঠের ঘাস, তেষ্টার জল তাকে খেতে দেয়নি তার কসুর তুমি মাপ করোনা"।মহেশের কথা মনে পড়ে গেলো এক মুহুর্তে,গেটের পাশেই রয়েছে তার নামাঙ্কিত সেই উক্তি।পায়ে পায়ে যত এগোলাম এই মন্দিরের ভিতরের পথে যেনো চোখের সামনে একে একে ভেসে উঠতে লাগলো রামেরসুমতি,শ্রীকান্ত,দেবদাস, দত্তা,নিষ্কৃতি,মহেশ,দেনাপাওনা,বৈকুণ্ঠের উইল।এই সব চিরস্মরণীয় লেখার সৃষ্টি এই বাড়িতেই। রয়েছে নিজের হাতে সযত্নে লাগানো সেই পেয়ারা গাছটি,যার উল্লেখ রয়েছে 'রামের সুমতি' তে।
চারিদিকে গাছগাছালি,পুকুর,ধানী জমি,ধানের গোলা নিয়ে রয়েছে তার বাড়িটি।যৌবনের অনেকটা সময় বর্মায় কাটিয়েছিলেন বলেই হয়তো শেষ জীবনের নিজের বাড়িটিও তাই বার্মি স্টাইলে তৈরি। দোতলা বারান্দা ঘেরা ৪০ ইঞ্চি চুন,সুরকি,পোড়া ইঁটের দেওয়ালের বাড়ি,কাঠের পিলার,পাথর ও মার্বেলের মেঝে।এখানে তিনি ছাড়াও থাকতেন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী হিরন্ময়ী দেবী ও দাদা স্বামীভেদানন্দ,তিনি বেলুড় মঠের মহারাজ ছিলেন।বাড়ির ভিতরের বাগানে তাঁদের তিনজনের সমাধি আজও বিরাজমান।
দিদি তার জীবনের মতই বারবার লেখাতেও প্রাধান্য পেয়েছে অবলীলায়। সামতাবেড়ে তার দিদি অনিলাদেবীর বিয়ে হয়।সেই সূত্রে এখানে যাতায়াত তাঁর ছিলই।পছন্দের ছিল এ গ্রাম।
১৮৭৬ সালের ১৫ই সেপ্টেম্বর হুগলির দেবানন্দপুরে জন্মেছিলেন তিনি।এরপর বাল্যকালের অনেকটা সময় কেটেছিল বিহারের ভাগলপুরে।১৮৯৩ সালে বর্মা (বর্তমানে মায়ানমার) যান। বর্মাতে রেলের কেরানীর কাজ করতেন।'শ্রীকান্ত' রচনা সৃষ্টি এখানেই,প্রেক্ষাপটও তাই এটাই। লেখকের মনে 'পথের দাবীর' জন্ম নেয় বর্মাতে থাকাকালীনই।পথের দাবীর পটভূমি তৈরি হলো,রাসবিহারী বসুর চরিত্রের আদলে তৈরি হলো 'সব্যসাচী'।

রেঙ্গুনে থাকাকালীন বিয়ে করেন শান্তিদেবীকে।কিন্তু স্ত্রী ও এক বছরের ছেলে ভয়াবহ প্লেগে মারা যান।দ্বিতীয় বিবাহ করেন বিধবা মোক্ষদাদেবীকে(যাঁকে পরবর্তীতে আমরা হিরন্ময়ী দেবী বলে চিনি)।স্ত্রীকে সমাজের কুসংস্কারের বাইরে বেরিয়ে লেখাপড়া শেখান নিজেই।১৯১৬ সালে ভারতে ফিরে আসেন।ফিরে কিছুদিন শিবপুরে ভাড়া ছিলেন।দিদির সুবাদেই ১৯১৯ সালে মাত্র ১,১০০ টাকার বিনিময়ে এই জমি কেনেন।গোপাল দাসের তত্ত্বাবধানে ১৯২৩ সালে তৈরি হয় এই বাড়ি।গৃহ প্রবেশ করেন ১৯২৬ সালে।১৯২৬-১৯৩৮ জীবনের এই শেষ বারোটি বছর অতিবাহিত করেন এই বাড়িতে।১৯৯৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল বাড়িটি,যা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক পুনরুদ্ধার করে হেরিটেজ সাইট ঘোষণা করা হয়।
নদীর দিকে মুখ করা তার লেখার ঘর।স্পর্শ করলাম উঠোন পেরিয়ে তার ঘরটিকে।এখানেই দিনের উজ্জ্বলতায় বা রাতের অন্ধকারের স্তব্ধতায় যাঁর কলমের নিব চুঁইয়ে নেমে এসেছিল কত না হৃদয়স্পর্শী লেখা। অবলীলায় লিখেছেন কত লেখা এখানেই বসে।সেই চেয়ার টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে মন আনমনা হয়ে যাচ্ছিল বারবার।যে ঘরে তিনি লিখতেন তা আজও সেভাবেই রয়েছে।এতই জীবন্ত, মনে হচ্ছিল বারবার আজও বুঝি তিনি লিখছেন,সেই কালো গরীব মেয়েটির কথা বা অভাগীর স্বপ্নের কথা।শোবারঘর,টান টান করা বিছানা সযত্নে গোছানো,বালিশ,ঘড়ি,রেডিও,ঠাকুরের সিংহাসন সবই রয়েছে আগের মতোই।আছে সোফা, হুঁকো,আলমারিতে বই,বেলজিয়াম কাঁচের একটি আয়না।আছে একটি চরকা,জেলা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন শরৎচন্দ্র এটি নিয়ে আসেন।ঘরের কোণে আছে রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি।আগে এটি ছিল ধানের গোলার পাশের একটি ঘরে।৭৮এর বন্যার পর সেই ঘরটি পড়ে যাওয়ায় সেই থেকে এখানেই নিত্যপুজো পেয়ে আসছে।দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস এরেস্ট হবার আগে এই মূর্তিটির দায়িত্ব দিয়ে যান লেখককে এবং তিনিও তার কথা রেখেছেন যথাযোগ্য মর্যাদায়।
বসার ঘরে এক সময় এসেছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস থেকে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন প্রমুখ বিপ্লবীরা।স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বিপ্লবীদের অন্যতম আশ্রয়স্থল ছিল এটি।এখানেই লেখেন তাঁর শেষ লেখা,স্বদেশী প্রেক্ষাপটের 'বিপ্রদাস'।দরিদ্র গ্রামবাসীদের জন্য তিনি দাতব্য চিকিৎসা করতেন,আলমারিতে রয়েছে সেই স্মৃতিচিহ্নগুলোও।বাড়ির পিছনে ছিল রান্নাঘর।ধানের গোলা।পায়ে পায়ে এলাম বাড়ির পিছনের দিকে।তার সামনে যেতেই একমুহূর্তে ভেসে উঠলো আমিনা বুঝি তার বাবার জন্য ভাত রাঁধছে।দালানে দাড়িয়েই মনে হলো....আর বাপের ক্রোধ দ্বিগুণ হইয়া গেলো "রোগা বাপ খাক আর না খাক,বুড়ো মেয়ে চারবার পাঁচবার করে ভাত গিলবি।এবার থেকে চাল আমি কুলুপ বন্ধ করে বাইরে যাবো"। তারই সামনে দিয়ে উঠে গেছে দোতলা যাবার সিঁড়ি।গা ছমছম কি শুধু ভূতের ভয়েই করে,না বোধহয়।অজানা ভালোলাগা,রোমাঞ্চ থেকেও করে,যা সেদিন দোতলায় লাল মেঝে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমার করেছিল।আজ যা বর্তমান,কাল ছিল অতীত,কাল হবে ভবিষ্যত।একসময় যে মানুষগুলো হেঁটে চলে বেড়াতো এ পথে আজ তাঁরা শায়িত বেদীতে।মৃত্যুর আগের কিছুদিন কলকাতার অশ্বিনী দত্ত রোডের বাড়িতে যান। অবস্থার অবনতি হলে আজকের পার্ক ক্লিনিক যাকে বলি আমরা সেখানেই ভর্তি হন ও ১৬ই জানুয়ারি ১৯৩৮ সালে,৬২ বছর বয়সে লিভার ক্যান্সারে মারা যান।
বর্তমানে বাড়িটির তত্ত্বাবধানে তার ছোটো ভাইয়ের নাতি জয় চট্টোপাধ্যায়,যিনি কলকাতার বাসিন্দা।বাড়িটি দেখাশোনার জন্য রয়েছে কেয়ার টেকার,যিনি যথেষ্ট যত্নমান মানুষ।ঘুরিয়ে দেখান সাথে অবলীলায় বলেন কত কথা।বাড়ির পুকুরের কথা,যেখানে আজও খেলে বেড়ায় কার্তিক,গণেশ নামক রুই কাতলা।পুকুরে টলটল করছে জল,আজও নিঝুম দুপুরে লেখক বুঝি বসেন এ ঘাটে,তলিয়ে দেখেন তার লেখার সব চরিত্রগুলোকে।পুকুরের ঘাটটি বড়ো সুন্দর,বসলে মন জুড়িয়ে যায়।একসময় পরিচ্ছন্ন দালানে হতো অন্নপূর্ণা পুজো।বাগানে রয়েছে কথা সাহিত্যিকের শ্বেত পাথরের একটি মূর্তি।বাড়ির পিছনের বাঁশ ঝড়ে কান পাতলে আজও শোনা যায় পার্বতী দেবদাসের ফিসফিসানি।এবার পরিক্রমা শেষ করার পালা।আবার আসিব ফিরে তবে ধান সিঁড়ি নয়, রূপনারায়ণ এর তীরে মনে মনে সেই কথা বলে পেয়ারা গাছের শুষ্ক গুঁড়িটায় একবার স্পর্শ করে বেরিয়ে পড়লাম।
কোথায় থাকবেন : যদি দেউল টিতেই থাকতে চান তবে নিরালা রিসোর্ট বা প্রান্তিকে থাকতে পারেন।আমরা নিরালায় ছিলাম।বেশ সুন্দর।মনোরম গাছ গাছালি দিয়ে ঘেরা,খাওয়া থাকা,বাচ্চাদের অফুরন্ত খেলার জায়গা সবই পাবেন।
থাকা-খাওয়ার জায়গা
১) নিরালা রিসোর্ট: 9831620901
২) প্রান্তিক রিট্রিট: 83358 88718
৩) রিল্যাক্স মন্জিল: 94339 49395
কাছাকাছি আর কি কি দেখতে পারেন : দেউলটির এই ভগবানের বাড়ির দর্শনের পর পায়ে হেঁটে ঘুরে নিতে পারেন গ্রামটি।বেশ সুন্দর। রয়েছে মন্দির।মেঠো পথ।রূপনারায়ণ এর ধারের শোভা।খুব কাছেই কোলাঘাট। এছাড়াও আরও দুটি জায়গা খুব কাছে - গাদিয়াড়া ও গড়চুমুক। শরৎকুঠি ঘুরে নিজের গন্তব্য অনায়াসেই পাল্টে নিতেই পারেন তাই।দেউল টিতেই দেখে নিতে পারেন বিরামপুর কালীবাড়ি।২৫০ বছরের পুরোনো রাধা ও মদন গোপাল মন্দির। টেরাকোটা কাজের আটচালা অপূর্ব মন্দির এটি।এটাও দেউলটির অন্যতম আকর্ষণ বলতেই পারেন।
কিভাবে যাবেন : গাড়ি নিয়ে যেতে পারেন NH-16 হাইওয়ে ধরে ,এছাড়া ট্রেনেও যেতেই পারেন। হাওড়া-মেদিনীপুর লোকাল বা খড়গপুর লোকাল ধরে দেউলটি স্টেশন।সেখান থেকে টোটোতে ১৫ মিনিটের মত লাগবে শরৎকুঠি।টোটোতে ভাড়া কিছুদিন আগেও ছিল ২০টাকা মাথাপিছু।
দেউলটির বিশেষত্ব : স্থানীয় দোকানের পেটাই পরোটা কিন্তু দারুণ। আর নামহীন গ্রাম্য অজানা দোকানের মিষ্টির স্বাদ যে কত সুন্দর তা না খেলে বুঝতামই না।
Related Posts : Rabindranath Tagore's House in England
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
If you have any query, please let me know.