Goyna Bori-Origin-History-Bengal Food Art
Goyna Bori-Origin-History-Bengal Food Art-Mahishadal Rajbari
কিছুদিন আগে ঘুরে এলাম পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল থেকে।আর পূর্ব মেদিনীপুর মানেই তো এই গয়না বা নকশাবড়ির উৎস বা জন্মস্থল।সেই প্রাচীন কাল থেকেই এখানকার মহিলারা নিপুণ হাতে সূক্ষ্ম নকশায় হালকা শীতে দেন এই বড়ি,তারপর কৌটো বন্দী করে রাখেন সারাবছর।এটাই তাদের পরম্পরা,ঐতিহ্য।যা তারা বয়ে নিয়ে চলেছেন সগৌরবে বংশানুক্রমে।অতিথি আপ্যায়নে,আত্মীয়বন্ধুর বাড়িতে পাঠানো বা নিত্য প্রয়োজনে ব্যাবহার করেন এই নজরকারা বড়ি।গরম ভাতে প্রথম পাতে এমন দৃষ্টিনন্দন বড়ি দেখে দ্বন্দ্ব হতেই পারে যে শুধু গয়নার বাক্সে রাখার জন্যই নাকি গয়না বড়ি খাওয়াও যায় কিনা।যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর উল্টো কথাই বলেছিলেন। বিশ্বকবির মতে ,গয়না বড়ি শুধু দেখার জন্য,খাওয়ার জন্য নয়। মেদিনীপুরের ঐতিহ্য এই বড়ি,হস্তশিল্পের ও কুটিরশিল্পের চরম নিদর্শনও বটে।স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর,নন্দলাল বসুও ছিলেন এর রূপ ও গুনমুগ্ধ।
Watch full video of Mahishadal Palace here with detailed history :
আমার এক পিসির শ্বশুরবাড়ি ছিল তমলুক।সেই সুবাদে রূপসী এই বড়ির সাথে পরিচয় ছিল আগে থেকেই।কিন্তু বাড়ির উঠোন,ছাদে যে কিভাবে বড়ি দেয়া হয়ে থাকে তা দেখার অভিজ্ঞতা প্রথম ও তা অভূতপূর্ব।কেমন সাবলীল ভাবে ছাঁচ বা নকশার সাহায্য ছাড়াই অনায়াসে মস্তিষ্কপ্রসূতভাবেই দিয়ে চলেছেন এই ডিজাইনার বড়ি।গয়না বড়ি বলতে বেশির ভাগই স্বর্ণালঙ্কার থেকে নেয়া চুড়ি, বালা,মুকুট,নেকলেস,টিকলি, বাজুবন্ধর নকশা।কোনটি বা বৃত্ত,ত্রিভুজ,চতুর্ভুজ,ফুল, পাতা,মাছ, পাখি এসব হরেক রকমের নকশা করা।
ঐতিহাসিক ও ভৌগলিক এই দুই প্রেক্ষাপটেই উজ্জ্বল এঁর জন্মবৃত্তান্ত।জন্ম বনেদী হাতের নৈপুণ্যে।মেদিনীপুরের তমলুক, কাঁথি, মহিষাদলের বনেদী বাড়ির গৃহিণীরা এই বড়ি প্রথম তৈরি করেছিলেন। ব্রিটিশ পিরিয়ডের কথা।ব্রিটিশদের আগে এই বড়ির উৎপত্তি হয়নি।পোস্তর সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত গয়না বড়ি।ব্রিটিশরা তাদের প্রজাদের দিয়ে কখনো নীল চাষ করিয়েছেন তো কখনো পোস্ত(আফিম)।পলাশীর যুদ্ধের পর ইংরেজ সরকার চীনে একটি বেআইনি আফিম চালানের বাজার আবিষ্কার করে, যাতে ছিল চরম মুনাফা।সেই সুবাদেই রাঢ় অঞ্চলের আশপাশে শুরু হলো পোস্তর চাষ।আফিম নিষ্কাশনের পর পোস্ত বীজ ফেলে দেয়া হতো।সেই থেকে বাঁকুড়া,বীরভূম,বর্ধমান মেদিনীপুরে শুরু হলো রান্নায় পোস্ত ব্যাবহারের চল।মেদিনীপুরে গহনা বড়িতে পোস্তর ব্যাবহার শুরু তখন থেকেই হয়।
Related Posts : Railway Mutton Curry, Ledikeni History
খাদ্যদ্রব্যের নাম ছাড়িয়ে বর্তমানে এটি লোকশিল্পের রূপ নিয়েছে।নন্দলাল বসুর কথায় 'নকশাগুলি সত্যিই শিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বঙ্গমাতার ভাঙ্গা ঝাঁপিতে এই অমূল্য রত্ন সন্ধান পাইয়া আমরা মুগ্ধ হইলাম'। শীতের মরসুম কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন বংশ পরম্পরায় চলে আসা কিছু কৌশল ও নিপুণ হাতের দক্ষতায় এই শিল্পকর্মের শুরু হয়।আমার মা ঠাকুমার বড়ি দেয়া নিজে চোখে দেখেছি। ধান,দুব্য,সিঁদুর দিয়ে তৈরি হতো ডালের বুড়ো বুড়ি,সেই বুড়ো বুড়ির বিয়ে দিয়ে শুরু হতো এই বড়ি হাত।তারপর চলতো সারা শীত জুড়ে,তবে সে বড়ি যদিও গয়না বড়ি নয়।গয়নাবড়ি মেদিনীপুরের একান্ত নিজস্ব।গয়না বড়ির জি আই (GI- Geographical Indication) স্বীকৃতি চায় মেদিনীপুর।
মহিষাদলের লক্ষ্যা গ্রামের মাইতি পরিবারের শরৎকুমারী দেবী ও হিরন্ময়ী দেবীর তৈরি গয়না বড়ির শৈল্পিক রূপ মন কেড়েছিল রবীন্দ্রনাথের।১৯৩০ সালে সেবা মাইতি নামক শান্তিনিকেতনের ছাত্রী গুরুদেবকে তার মা শরৎকুমারী দেবী ও ঠাকুমা হিরন্ময়ী দেবীর তৈরি বড়ি উপহার দিয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ সেই বড়ির আলোকচিত্র কলাভবনে সংরক্ষণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে অনুমতি পত্র লিখেছিলেন হিরন্ময়ী ও শরৎ কুমারী দেবীর উদ্দেশ্যে। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বড়িকে ভেজে খাওয়াকে শিল্পকে ধ্বংস করার সমতুল্য বলে মনে করতেন।সত্যজিৎ রায়ের 'আগন্তুক' সিনেমার শুটিংয়ের গয়না বড়ি এসেছিল ময়না রাজ পরিবার থেকে।গয়না বড়ি এই অঞ্চলে হওয়ার পিছনে কিছু কৌশল আছে এখানকার নিজস্ব।দোকানের পুরোনো বিউলির ডালে কিন্তু হয় না গয়না বড়ি।শীতকালে ওঠা খোসা শুদ্ধু ডালই ব্যাবহার করা হয়।আগের দিন সারা রাত ভিজিয়ে রাখা হয়।তারপর সকালে উঠে খোসা ছাড়িয়ে সিলে মিহি করে বেটে নেয়া হয়। ফেটানোর মধ্যেই লুকিয়ে থাকে বড়ি মুচমুচে হওয়ার রহস্য। যত ফেটানো হবে ডাল,তত হালকা হবে বড়ি।কাঁসার থালায় হালকা তেল মাখিয়ে পোস্ত ছড়িয়ে তবে দেয়া হয় বড়ি।একহাতে কাপড়ের পুঁটুলি, যাতে থাকে ডালের লেই ও আর এক হাতে থাকে নকশা করার জন্য পরিষ্কার নারকেলের কাঠি।যদিও দক্ষ মহিলাদের কাঠির সাহায্যও লাগে না। ডালের পেচের মাধ্যমেই করে ফেলতে পারেন নকশা বড়ি।
১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝি পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন বিভাগ আয়োজিত খাদ্য মেলায় প্রথম তমলুক থেকে মহিলারা এসে জনসমক্ষে বড়ি দিয়ে দেখান।তার পর টিভি,খবরের কাগজ মাধ্যমে প্রচারের আলোয় আসে ধীরে ধীরে।বর্তমান যেকোনো হস্তশিল্প মেলায় আজ সহজেই পাবেন।এছাড়া মেদিনীপুরের দোকানে দোকানে পাবেনই। প্যাকেট পিছু ২৫ টাকার বিনিময়ে পাবেন ৫ টি পোস্ত গয়না বড়ি।তবে সুজি ছড়িয়েও হয় গয়না বড়ি, যার দাম ও কম।
শীতের হালকা রোদই এর উপযুক্ত। কড়া রোদে বড়ি ভেঙে যায়।তাই কড়া রোদের আশঙ্কায় জায়গায় জায়গায় পাতলা কাপড়ের আচ্ছাদন দেখলাম।
পোস্ত ও বিউলির ডাল দুটোরই দাম আকাশচুম্বী, তাও গরীব গ্রামের মেয়েরা শুধুমাত্র পরম্পরা ধরে রাখতে দেন এই বড়ি।তবে বর্তমানে ব্যাবসার জায়গাতেও আসছে এই গয়না বড়ি।তাই অল্প টাকা হলেও টাকা আসে বলে জানান মহীষাদল,গেওখালির মেয়েরা।যা স্থানীয় বাজার হয়ে পৌঁছায় কলকাতাতে।তবে রবীন্দ্রনাথ,অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যাই বলুন শুধু কি দেখলে আশ মেটে এমন সুন্দর খাদ্যবস্তু একবার খেয়েও তো দেখতে হয়। পেটের ক্ষুধার সাথে সাথে মনের ক্ষুধাও তো মেটানোর দায় আমাদেরই।
মহিষাদলের সকাল,হালকা শীত শীত,পাখির কিচকিচানি,জায়গায় জায়গায় গয়না বড়ি শুকোতে দেয়া, দানাবিহীন খেজুরের গুড়ের জ্বাল দেয়া চলছে,তার মিষ্টি গন্ধ।সব মিলিয়ে অন্যরকম সকাল,কলকাতায় কখনো এমন সকাল দেখার সুযোগ হয় না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
If you have any query, please let me know.